15 C
Dhaka
Monday, December 23, 2024

‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ ছড়িয়ে লুটে নিচ্ছে সর্বস্ব

দেশে অভিনব কৌশলে বেড়ে চলেছে নানা প্রতারণা ও ছিনতাই। প্রতারণার নিত্যনতুন পন্থা অবলম্বন করে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে একটি ভয়ংকর অপরাধী চক্র। হঠাৎ রাস্তায় পথ আগলে বা খুব কাছাকাছি এসে অপরিচিত কেউ জানতে চান ঠিকানা, কখনো আবার বাড়ি ভাড়া নিতে এসে আবেগ দিয়ে জড়িয়ে ধরছেন বা দোকানে কিছু কিনতে এসে গা ঘেঁসে দাঁড়াচ্ছে।

বিপরীত দিকের মানুষের সঙ্গে এমন আলাপের মাত্র দুই/তিন মিনিটের মধ্যেই তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যান ভুক্তভোগী। এভাবে মাইন্ড কন্ট্রোলে নিয়ে অপরাধীরা হাতিয়ে নিচ্ছেন স্বর্ণালংকার, টাকাপয়সাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র।

এই পন্থা দেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এর মাধ্যমে একজন প্রতারক কিংবা ছিনতাইকারী ভুক্তভোগীকে চাইলেই কাবু করে নিজের ইশারায় নাচাতে পারেন। প্রতারক যে নির্দেশনাই দেবেন, তা-ই অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন সেই নিরীহ ভুক্তভোগী। বিষয়টি জাদুটোনার মতোই কাজ করে। এর পেছনে কারণ হিসেবে উঠে আসছে স্কোপোলামিন নামে একটি ড্রাগের কথা।

বলা হচ্ছে, এটা তরল কিংবা পাউডার দুই ধরনেই পাওয়া যায়। অপরাধের ক্ষেত্রে এই ড্রাগ কাগজ, কাপড়, হাত এমনকি মোবাইলের স্ক্রিনে লাগিয়েও এর ঘ্রাণ দিয়ে কিছু সময়ের জন্য যে কারো মানসিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে আসলেই কি এমন কোনো ড্রাগ আছে? আর থাকলেও এটা বাংলাদেশে ব্যবহার হচ্ছে কি না সেটাই বা কতটা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে?

বাংলাদেশে স্কোপোলামিন ব্যবহারের প্রমাণ কী?

বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটি বেসরকারি বিশ্ববদ্যিালয়ের শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। সেই হত্যার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করে, পরে আরো একজনকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে একজনের কাছে প্রথমবারের মতো স্কোপোলামিন পাওয়ার কথা জানায় পুলিশ। তখন বোতলের ভেতর সাদা পাউডার আকারে কয়েক গ্রাম স্কোপোলামিনসহ আরো কয়েক ধরনের মাদক জব্দ করা হয়। পরে আদালতের আদেশ নিয়ে সিআইডি’র ল্যাবে টেস্ট করার পর সেখানে স্কোপোলামিন শনাক্ত হয়।

আরও পড়ুনঃ  গরু পাগলামি করে, তাই নাম জায়েদ খান

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল গণমাধ্যমকে বলেন, রাসায়নিক পরীক্ষার যে রিপোর্টটা আমরা পেয়েছি সেই রিপোর্টে স্কোপোলামিন, পটাশিয়াম সায়ানাইড ও ক্লোরোফর্ম শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে স্কোপোলামিন ছিল আমাদের কাছে একেবারেই নতুন। এই নাম, এর ব্যবহার, কোন কোন ক্ষেত্রে এটা কাজে লাগানো হতে পারে সেটা আমরা জানতাম না। পরে এটা নিয়ে স্টাডি করে আমরা জানতে পারি যে, এটাকে আসলে ‘ডেভিলস ব্রেথ’ বা ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ বলে অনেকে। এই কর্মকর্তা জানান, তারা এখনও পর্যন্ত তদন্তে যেটা পেয়েছেন সেটা হচ্ছে এই ড্রাগ কুরিয়ারের মাধ্যমে এবং বিভিন্নভাবে চোরাকারবারিরা দেশে আনছে।

ধুতরার ফুল থেকে স্কোপোলামিন বানায় কারা?

স্কোপোলামিন মূলত একটি সিনথেটিক ড্রাগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ওষুধ তৈরিতে এর ব্যবহার আছে। বমি বমি ভাব, মোশন সিকনেস এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশন পরবর্তী রোগীর জন্য ওষুধে এর ব্যবহার আছে। তবে এটা প্রাকৃতিক কোনো উপাদান নয়। বরং প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে আরো কিছু যোগ করে কৃত্রিমভাবে স্কোপোলামিন তৈরি করা হয়। এটা তরল এবং পাউডার দুই রূপেই পাওয়া যায়। তবে এর গুরুত্বপূর্ণ বা মূল উপাদান আসে ধুতরা ফল থেকে।

আরও পড়ুন: নারীসহ ওই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন এমপি আনার: এনডিটিভি

আরও পড়ুনঃ  যেভাবে খুন করা হয় এমপি আনারকে

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা জানান, আমাদের দেশে একসময় মানুষকে পাগল করে দেয়ার জন্য দুধের মধ্যে ধুতরা বেটে খাইয়ে দেয়া হতো। ধুতরা ফুল কিন্তু একটা বিষ। ঐ ধুতরা থেকে উপাদান নিয়ে সিনথেটিক্যালি এটা বানানো হয়েছে। মেক্সিকোর যে মাদক চক্র আছে, তারা এই মাদকটা বানিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে।

স্কোপোলামিন কখন, কীভাবে কাজ করে?

স্কোপোলামিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে ব্যবহারের নজির আছে। তখন এর ব্যবহার হতো লিকুইড হিসেবে, ইনজেকশনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সায়েদুর রহমান বলেন, ওষুধ হিসেবে স্কোপোলামিনের ব্যবহার এখনও আছে। তার কথায়, এটা এবং এর মতো আরো বেশ কিছু ওষুধ চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয়। এটা সত্য।

স্কোপোলামিন প্রথম দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা জ্ঞিাসাবাদের ক্ষেত্রে ‘ট্রুথ সেরাম’ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। অর্থাৎ এটা যদি ইনজেক্ট করে দেয়া হয় তাহলে সে সত্য কথা বলতে শুরু করে। কারণ তার মগজের উপর নিজস্ব যে নিয়ন্ত্রণ সেটা চলে যায়। সে তখন অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, অন্যের কথা শুনতে থাকে।

তিনি বলেন, যখন আপনি কথা বলানোর জন্য ব্যবহার করছেন তখন এটা ট্রুথ সেরাম। যখন আপনি পাউডার ফর্মে নিঃশ্বাসের জন্য ব্যবহার করছেন তখন এটা ‘ডেভিলস ব্রেথ’। আর যখন এটা বমি অথবা মোশন সিকনেসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন তখন এটা আসলে মেডিসিন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  ‘সিদ্ধান্ত নিয়েছি ব্যাংক খুলব না, খুলে গ্রাহকদের মার খাব নাকি’

আরও পড়ুন: এমপি আনারের মরদেহের খণ্ডিত অংশ উদ্ধারে কসাই জিহাদকে নিয়ে তল্লাশি

বর্তমানে স্কোপোলামিন মূলত পাউডার হিসেবে প্রতারণার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ভিজিটিং কার্ড, কাগজ, কাপড় কিংবা মোবাইলের স্ক্রিনে এটি লাগিয়ে কৌশলে টার্গেট করা ব্যক্তিদের নিঃশ্বাসের কাছাকাছি আনা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, স্কোপোলামিন মানুষের নাকের চার থেকে ছয় ইঞ্চি কাছাকাছি আসলেই নিঃশ্বাসের আওতায় আসে।

তার কথায়, এটা নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঢুকলেই মাত্র ১০ মিনিট বা তারও আগে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। মেমোরি আর ব্রেন তখন সচেতনভাবে কাজ করতে পারে না। কারো ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হতে এক ঘণ্টা লাগে। আবার কেউ তিন/চার ঘণ্টার মধ্যেও স্বাভাবিক হতে পারে না।

বাংলাদেশে শুরুতে ঢাকায় পাওয়া গেলেও পরে স্কোপোলামিন ব্যবহার করে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতেও। যদিও এমন ঘটনার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে মাদক কারবারীরা স্কোপোলামিন আনছে সেটিও একটা বড় প্রশ্ন।

নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর গোয়েন্দারা তথ্য পান স্কোপোলামিন অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। মূলত যে দু’জন আটক হয় তারা অনলাইনে বিক্রির সঙ্গেই জড়িত বলে জানাচ্ছে পুলিশ। আর এগুলো আসছে মূলত দেশের বাইরে থেকে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিস। তবে ওষুধের কাঁচামাল হিসেবেও আইনের ফাঁক গলিয়ে কেউ স্কোপোলামিন আনছে কি না সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

আপনার মতামত লিখুন:
সর্বশেষ সংবাদ পড়ুন
জনপ্রিয় সংবাদ