লিবিয়ায় নাটোরের গুরুদাসপুরের চার যুবককে অপহরণ করে ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছে অপহরণকারীরা। মুক্তিপণ নিশ্চিত করতে তাদের নির্যাতন করে সেই দৃশ্যের ভিডিও পাঠানো হচ্ছে দেশে ওই যুবকদের পরিবারের সদস্যদের কাছে। নির্যাতনের এমন ভিডিও দেখে আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন স্বজনরা। অপহৃত চার যুবক একে অন্যের আত্মীয় বলেও জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুই বছর আগে গুরুদাসপুর উপজেলার বিয়াঘাট এলাকার সোহান প্রাং, সাগর হোসেন, নাজিম আলী ও বিদ্যুৎ হোসেন লিবিয়ায় যান। তারা চারজন একসঙ্গেই থাকতেন। গত ২ জুন রাতে তাদের অপহরণ করা হয়। এরপর থেকেই পরিবারের কাছে চাওয়া হচ্ছে ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ। এ মুক্তিপণ পেতে তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে ভিডিও কল দিয়ে চালানো হচ্ছে নির্যাতন।
অপহৃত সোহানকে নির্যাতনের একটি ভিডিও ক্লিপ গত বৃহস্পতিবার দুপুরে পাঠানো হয় তার পরিবারের কাছে। নিষ্ঠুর সেই নির্যাতন দেখে তার পরিবারে চলছে আহাজারি। অচেতন হয়ে পড়ছেন স্বজনরা।
জানা গেছে, অপহৃত চারজনই আত্মীয় হওয়ার সবার পরিবারের সদস্যরা সোহানের বাড়িতে এসে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন।
অপহৃতদের পরিবারের সদস্যরা জানান, অভাবের কারণে প্রত্যেকের পরিবার ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ করে তাদের লিবিয়া পাঠান। প্রতি মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার করে টাকা তারা দেশে পাঠালেও সংসারে খরচের কারণে ঋণের টাকা এখনো পরিশোধ হয়নি। এর মধ্যেই তাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ হিসেবে ৪০ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে। এ টাকা সংগ্রহ ও সন্তানের বেঁচে ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছে ওই চার যুবকের বাবা-মা।
জিম্মি থাকা সোহানের বাবা শাহজাহান বলেন, ‘সোহানের মায়ের মোবাইল ফোনের ইমু নম্বরে লিবিয়া থেকে কল আসে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সোহান বলছিল, “মা বাঁচাও, বাবা বাঁচাও, আমাকে অপহরণ করে নিয়ে আসছে কারা যেন, বলতেছে ১০ লাখ টাকা দিতে হবে, না দিলে মেরে ফেলবে, এবারের মতো আমাকে বাঁচিয়ে আমার জীবন ভিক্ষা দাও মা”। তারপর সোহানকে একটি রুমের মধ্যে বেঁধে রেখে মারধরের ভিডিও পাঠায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুই বছর আগে জমি বন্ধক রেখে ও ঋণ করে প্রায় ৪ লাখ টাকা খরচ করে লিবিয়ায় পাঠিয়েছি ছেলেকে। দুই বছরে প্রতি মাসে ১৫-২০ হাজার করে প্রায় ২ লাখ টাকা দিয়েছে। সেই টাকা সংসারেই খরচ করছি। এখন পর্যন্ত ঋণ পরিশাধ করতে পারিনি। এখন আবার ছেলেকে জিম্মি করে চাচ্ছে ১০ লাখ টাকা। আমাদের ঘরবাড়ি-ভিটে মাটি বিক্রি করলেও এত টাকা হবে না। এখন ছেলেকে কীভাবে উদ্ধার করব? সরকারের সহযোগিতা চাই ছেলেকে উদ্ধার করার জন্য।’
জিম্মি থাকা আরেক যুবক নাজিমের স্ত্রী নাদিরা বেগম বলেন, ‘এখনো বৃষ্টি হলে ঘরের চালা দিয়ে পানি পড়ে। সংসারে সচ্ছলতা নিয়ে আসার জন্য অনেক আশা নিয়ে স্বামীকে ঋণ করে ৪-৫ লাখ টাকা খরচ করে প্রবাসে পাঠিয়েছিলাম। এখন সব স্বপ্ন ভেঙে গেছে। স্বামীকে অপহরণকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে হলে দিতে হবে ১০ লাখ টাকা। বাড়িতে ঠিকমতো চাল থাকে না। অনেক সময় না খেয়ে থাকতে হয়। কীভাবে ১০ লাখ টাকা দিয়ে স্বামীকে উদ্ধার করব?’
অপহৃত সাগরের চাচি করিমন বেগম বলেন, অপহৃত চারজন পরস্পর আত্মীয় হওয়ায় তারা লিবিয়ায় একসঙ্গে থাকত। পরিবারগুলোর অবস্থা এখন নাজেহাল। কারোরই নাওয়া-খাওয়া নেই। ভিডিও কলে নির্যাতনের দৃশ্য দেখে সবাই অচেতন হয়ে যাচ্ছে। চারজনকে উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘অপহরণকারীরা বাংলাদেশি। তারা বাংলাদেশের একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা দাবি করেছে। তবে পরিবারগুলোর পক্ষে টাকা পরিশোধের সামর্থ্য না থাকায় ওই চার যুবকের জীবন এখন হুমকির মুখে। সরকারের কাছে তাদের উদ্ধারের পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাই আমরা।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গুরুদাসপুর থানার ওসি উজ্জ্বল হোসেন বলেন, ওই চার যুবকের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ না দিলেও তারা পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। বিষয়টি পুলিশ সুপারের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে।